তারকা হয়ে উঠার গল্প একজন গ্যাব্রিয়েল জেসুসের

তারকা হয়ে উঠার গল্প একজন গ্যাব্রিয়েল জেসুসের

১৯৯৭ সালের ৩রা এপ্রিল সাও পাওলো'র এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জেসুস। চার ভাইয়ের মাঝে জেসুস ছিলো সর্বকনিষ্ঠ। জেসুসের যখন চার বছর বয়স, তার বাবা তাদের পরিবারকে রেখে দ্বিতীয় বিবাহ করে নেন। পরবর্তিতে জেসুসের বাবা পরিবারের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। চার সন্তানের পরিবারের হাল ধরতে কাজে নেমে পড়েন জেসুসের মা। প্রথমে কাপড় সেলাই এবং পরে একটি হোটেলে কাজ করে তিনি সংসার চালাতেন এবং চার ছেলের পড়ালেখার খরচ যোগাতেন। জেসুসের মা অত্যান্ত ধৈর্যশীলা একজন মাণুষ ছিলেন, একই সাথে ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। তিনি তার সন্তানদের পড়ালেখার ব্যাপারে যথেস্ট সচেতন ছিলেন। তিনি তার সন্তানদের সবসময় একটা কথাই বলতেন- যদি তুমি কালো এবং গরীব হয়ে জন্মাও, তবে তোমাকে অনেক ভালোভাবে পড়াশোনা করতে হবে এবং অবশ্যই তোমাকে অনেক ভালোভাবে পড়াশুনা করতে হবে। কঠোর পরিশ্রম'ই সাফল্যের একমাত্র মন্ত্র, সর্বদা এটিই শিক্ষা দিতেন উনার সন্তানদেরকে।



বড় তিন ছেলে নিয়মিত পড়াশোনা করলেও, ছোট ছেলে ছিলো একদমই বিপরীত। সবসময় পাড়ার মাঠে পরে থাকত, সাথী বলতে কেবল একটাই বস্তু - ফুটবল। সকাল থেক শুরু করে সন্ধ্যা অব্দি কেবল ফুটবল নিয়েই সময় কাটাতো জেসুস। পাড়ার বড়ভাইদের সাথে এক মহল্লা থেকে অন্য মহল্লায় চলে যেতো পিচ্চি জেসুস, শুধুমাত্র ফুটবলের নেশায়। মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন খেলাধুলা করে কি বা করবে জীবনে; ভেবে জেসুসের মা জেসুস কে সবসময় বকাবকি করত, পড়াশুনা করানোর চেস্টা করত। কিন্তু জেসুস কে রুখে, সাধ্যি কার! জেসুসের ধ্যান জ্ঞান সবই যে কেবলই ফুটবল! তার মা একসময় বুঝতে পারে, ফুটবলের ভুত তার ছেলের মাথা থেকে নামানো সম্ভব না। এক সন্ধ্যায় তিনি তার ছোট ছেলেকে বুকে জড়ায়ে নিয়ে বলেন- বাবা, পৃথিবীর যেকোন সাফল্যর পিছনে একটাই কেবল মন্ত্র থাকে তা হলো কঠোর পরিশ্রম। ব্যাস! ফুটবলের পিছনে ছুটা আর কখনও থামাতে হয়নি জেসুস কে।



জেসুসের বয়স তখন ৯। Anhanguera নামে সাও পাওলো তে একটি সোশ্যাল প্রজেক্ট আছে, যারা বাছাইয়ের মাধ্যমে ১০-১৪ বছর বয়সী শিশুদের Varzea খেলার সুযোগ করে দেয়া হয়। Varzea হলো একটি ফুটবল টুনার্মেন্ট, যেখানে ছোট ছোট ছেলেদের অপ্রস্তুত, হালকা উঁচুনিচু শক্ত মাটির মাঠে খেলানো হয়। এর মাধ্যমে বলের বাউন্স নির্ণয় করে বল রিসিভ, এবং পাসিং শিখানো হয়। ২০০৬ সালে জেসুসের সুযোগ হয় এই টুনার্মেন্ট খেলার। টুনার্মেন্টিতে ভালো খেলার পরে পিকুইনেনোস নামের একাডেমি তাকে দলভুক্ত করে। একাডেমী টি সাও পাওলো মিলিটারি জেলের একটি মাঠ কে তাদের ট্রেনিং ও প্লেয়িং গ্রাউন্ড হিসেবে ব্যাবহার করত। এরপর থেকেই জেসুসের প্রতিটা সময় কাটতে থাকে সাও পাওলোর মিলিটারি জেলের মাঠে। মাত্র কয়েকদিনেই কোচের সুনজরে পড়ে যায় জেসুস। একাডেমী কর্মকর্তা আলাদাভাবে নজর দিতে শুরু করে জেসুসের প্রতি। মাঠে জেসুসের পারফরমেন্স, খেলার নেশা, সারদিন বিরামহীন ভাবে বল নিয়ে সময় কাটানো, কোচ কে আশা জাগায়। বাকী সব প্লেয়ারদের চেয়ে সবসময় বেশি ট্রেনিং করত জেসুস, ক্লান্তি যেনো কিছুতেই তাকে স্পর্শ করতোনা। তৎকালীন কোচ এক সাক্ষাতকারে বলেন- তিনি নিজেই মাঝে মাঝে জেসুস কে ট্রেনিং করিয়ে ক্লান্ত হয়ে যেতেন। জেসুস মাঝে মাঝে ছুটির দিনেও ট্রেনিং করতে চলে আসতেন। মিলিটারি জেলের সোডিয়াম বালব'এও জেসুস মাঝে মাঝে ফুটবল নিয়ে প্র‍্যাক্টিস করতো।
জেসুসের এমন কঠোর পরিশ্রমের কথা শহরে সবার মুখে মুখে ছড়তে থাকে। লোকাল টুনার্মেন্ট গুলোতে নিয়মিত ভালো খেলা তার প্রতি স্কাউটদের সুনজর আনতে বেশি সময় লাগায়নি। ১৪ বছর বয়সী জেসুস কে নিয়ে টানাপোড়ন লেগে যায় ক্লাবগুলোতে। শেষমেশ জেসুসের মা'র সাথে কথা বলে, ২০১২ সালের আগস্টে পালমেইরাস তাকে নিজেদের ডেড়ায় টানে। কিন্তু সে সময় জেসুসের বয়স ১৪ পুর্ণ না হউয়ায়, বি চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে পারেনাই। সে যেখানেই যেতো, ফুটবলটাকে উপভোগ করত। পালমেইরাসের অ-১৪ দলেও সে নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবে মানিয়ে নেয়, সেখানেও নিজের প্রতিভাকে জানান দিতে থাকে। ২০১৩ সালে অ-১৭ স্টেট চ্যাম্পিয়নশিপ এ পুরো ব্রাজিল জুরে নিজের নাম জানান দেন জেসুস, পালমেইরাসের হয়ে করেন ২৮ ম্যাচে ৩৭ গোল। ব্রাজিলবাসী তাকে ভবিষ্যৎের কান্ডারি হিসেবে ভাবতে থাকেন, ফুটবল বোদ্ধ্বারা তাকে রোনালদো ফেনোমেননের ভবিষ্যৎ যোগ্য উত্তরসুরী হিসেবে অভিমত দেন। জেসুস হয়ে উঠেন নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন।



ইতিমধ্যে জেসুস কে কেনার জন্য অন্যান্য ক্লাব থেকে লোভনীয় প্রস্তাব আসতে থাকে। জেসুস নিজেও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ঠিক সেই সময়  পালমেইরাস কোচ তাকে ব্রাজিল অ-২০ দলে ঢুকার সম্ভাবনা সম্পর্কে অভিহিত করেন, ভালো পারফর্ম করলে যে অলিম্পিক দলেও নাম উঠে যেতে পারে তা জানান দেন, এবং নিজের খেলার প্রতি মনোযোগ বাড়ানোর নির্দেশনা দেন। জেসুস ক্লাব ছাড়ার চিন্তা ঝেড়ে ফেলে খেলায় ধ্যান দেন।



ভালো খেলে যাওয়ার প্রতিদান স্বরুপ ২০১৫ সালে অনুর্ধ্ব ২০ বিশ্বকাপের দলে জায়গা করে নেন। একই বছর পালমেইরাস মুল দলে জায়গা করে নিয়েই জিতে নেন বেস্ট নিউকামার এওয়ার্ড। ২০১৬ সালে ব্রাজিল কে এনে দেন অধরা অলিম্পিক স্বর্ণপদক। একই বছর ব্রাজিলের নতুন কোচ টিটের অধীনে ব্রাজিল দলের ঐতিহাসিক ৯ নাম্বার জার্সি গায়ে চড়ান। ২০১৭ সালের জানুয়ারি তে পাড়ি জমান ইংল্যান্ড এ, ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে নাম লেখান জেসুস। এরপর থেকেই জেসুস নামক ট্রেন চলছেই। ব্রাজিলের হলুদ জার্সি কিংবা সিটির আকাশী নীল জার্সি, জেসুস যেনো ছুটে চলছে অদম্য গতিতে, আপন শক্তিতে, নিজস্ব মহিমায়।

No comments

Powered by Blogger.